সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে দেশটিতে এখন রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে। জনসমাবেশে ‘অভিযোগমূলক’ মন্তব্য করায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে এ মামলা করে। শ্রোতের বিপরিতে রাজনীতিতে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাওয়া ইমরানের সামনে এখন কী আছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণমূলক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা। আল জাজিরার সে প্রতিবেদনটি ‘যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বাংলা সংবাদমাধ্যম এখন সময়’ পাঠকদের জন্য সম্পূর্ন তুলে ধরা হলো-

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক ক্রিকেট তারকা ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ইমরান খানকে ঘিরে পাকিস্তান এখন উত্তাল। ঘটনার শুরু গত শনিবার (২০ আগস্ট)। ওই দিন ইসলামাবাদে এক সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সমালোচনা করেন ইমরান খান। এর পরই তাঁর বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির মিডিয়া নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। এখানেই থেমে থাকেনি ঘটনা। এরপর ইমরানে বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে। বিচারপতি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে হুমকি দিয়েছেন মর্মে তাঁর বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের মারগাল্লা থানায় মামলা করেছে স্বয়ং রাষ্ট্রপক্ষ।

পরে গ্রেপ্তার এড়াতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন ইমরান। তাঁর সমর্থক ও নেতা-কর্মীরা নেমে আসেন রাস্তায়। শেষে ইমরানের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন ইসলামাবাদ হাইকোর্ট। তবে তা মাত্র তিন দিনের জন্য। ফলে গ্রেপ্তারের আশঙ্কা রয়েই গেছে ইমরান খানের।

কী ছিল ইমরানের বক্তব্যে : শনিবার সন্ধ্যায় ইসলামাবাদের বক্তৃতায় ইমরান বলেছিলেন, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গত সপ্তাহে শাহবাজ গিলকে গ্রেপ্তার করার সময় তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করা হয়েছে। এ জন্য তিনি অসদাচরণ করা একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন নারী বিচারক, পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন।

ইমরানের দল পিটিআইকে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শাহবাজ গিলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। উল্লেখ্য, শাহবাজ গিল ইমরান খানের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। পুলিশ অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে নির্যাতন করার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আরও পড়ুন : পুলিশের মামলায় গ্রেফতার হতে পারেন ইমরান খান

 

ইসলামাবাদের পুলিশ ইমরান খানের বক্তব্যের নিন্দা করে বলেছে, পুলিশকে হুমকি দিলে কিংবা মিথ্যা অভিযোগ করলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটাই নিয়ম। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহও রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইমরানের বক্তব্য উসকানিমূলক। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলার কথা ভাবা হচ্ছে। রানা সানাউল্লাহর বক্তব্যের পর ওই দিনই পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা ইমরান খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

কেন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা : ইসলামাবাদের ওই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বিচারক আলী জাভেদ। তিনি বলেন, ‘ইমরান খানকে আমি বলতে শুনেছি, তিনি হুমকি দিয়ে বলেছেন যে আপনারা প্রস্তুত হোন। আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আপনাদের দেখে নেব। অবশ্যই আপনাদের লজ্জিত হতে হবে।’

এ ধরনের বক্তব্যকে সরাসরি পুলিশের বিরুদ্ধে হুমকি ও রাষ্ট্রদ্রোহ আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয় ইমরানের বিরুদ্ধে। এটি একটি ঔপনিবেশিক যুগের আইন। এ আইনে গ্রেপ্তার হলে ইমরানকে বছরের পর বছর কারাগারে থাকতে হতে পারে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিভিন্ন ধারা, সতর্কতা ও শাস্তির বিধান রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে কঠোরতম শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

ক্রমাগত বিস্ফোরক মন্তব্য : গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ইমরান খান বিভিন্ন সমাবেশে পুলিশ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। পিটিআইয়ের এই শীর্ষ নেতা বরাবরই অভিযোগ করছেন, বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আঙুল তুলেছেন তিনি, যদিও এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি ইমরান খান।

এ ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ইমরান। তিনি বলেছেন, নিরপেক্ষ বাহিনীর চাপেই গত ২৫ মে পুলিশ আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংসতা চালিয়েছে। নিরপেক্ষরা কি সত্যিই নিরপেক্ষ? নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ইমরান। তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের প্রধানও রাজনৈতিক চাপের কারণেই পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

গ্রেফতার বা কারাগারে যেতে পারেন ইমরান খান : পাকিস্তানের আইনি ব্যবস্থায় পুলিশ কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বিচারকের কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন পেশ করেন। এটি এফআইআর বা ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট নামে পরিচিত। এরপর বিচারক সবুজ সংকেত দিলে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে পুলিশ।

ইমরান খানের আইনজীবী ফয়সাল ফরিদ চৌধুরী বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন এফআইআর অবিলম্বে বাতিল করা হবে। কারণ এটি সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী রায়ের স্পষ্ট লঙ্ঘন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ আবুজার সালমান নিয়াজি বলেছেন, ইমরানের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। উচ্চ আদালতে গেলেই এটি বাতিল হয়ে যাবে।

আবুজার সালমান নিয়াজি আরও বলেছেন, আমরা আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব, শুধু এটুকু বললেই সন্ত্রাসবাদ হয়ে যায় না। এমনকি এটি পাকিস্তান দণ্ডবিধির অধীনে অপরাধমূলক ভয় দেখানোর মতো ঘটনাও নয়। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ইমরান খানের আগাম জামিন নেওয়া আছে। এরপর তাঁকে স্থায়ী জামিন নিতে হবে। একবার স্থায়ী জামিন নিতে পারলে তাঁকে আর কারাগারে ঢোকানো যাবে না। আবুজার সালমান নিয়াজি বলেছেন, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী মামলাগুলো সাধারণত যৌক্তিক কারণে হয় না, বরং এটি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের নামে কি ‘রাজনৈতিক নিপীড়ন’ : হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর জন সিফটন মনে করেন, পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অত্যন্ত বিস্তৃত। এ আইনের ভেতরে অনেক ‘অস্পষ্ট ভাষা’ রয়েছে এবং অতীতে ‘রাজনৈতিক বক্তৃতায় লাগাম টানতে’ এ আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে।

পাকিস্তান সরকার যদি মনে করে ইমরান খানের বক্তব্য সহিংসতা উসকে দেবে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য তাঁর বক্তব্য সত্যিই হুমকিমূলক, তাহলে অন্য অনেক আইন রয়েছে, যা দিয়ে ইমরানের বিচার করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেছেন জন সিফটন।

লাহোরের আইনজীবী ও আইন বিশ্লেষক আসাদ রহিম খান বলছেন, ইমরানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। তবে শনিবারের সমাবেশে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিও অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিল।

কী ঘটবে সামনে : আদালতের কাছ থেকে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আগাম জামিন নিয়েছেন ইমরান খান। ফলে বৃহস্পতিবার তাঁকে সন্ত্রাসবিরোধী আদালতে হাজির হতে হবে বলে জানিয়েছেন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ হায়দার রসুল। তিনি বলেছেন, ইমরান খানকে ব্যক্তিগতভাবে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে। শুধু পাল্টা যুক্তিতে মামলা খারিজ হবে না। তাঁকে আদালতে হাজির হতে হবে এবং তাঁর জামিনের বন্ড জমা দিতে হবে। এরপর সম্ভবত তাঁকে আরও কয়েক দিনের অতিরিক্ত জামিন দেওয়া হতে পারে। তবে এর বিপরীত ঘটনাও ঘটতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন হায়দার রসুল। যেমন, ইমরানকে জামিন না দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা খুব কম।

যদি ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করাই হয়, তাহলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে পারে। কারণ ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে দেশটির বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে। বিক্ষুব্ধ ইমরানভক্তরা তখন পথে নেমে আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এতে দেশজুড়ে তৈরি হতে পারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। আর কে না জানে, অস্থিতিশীলতাই মসনদ পরিবর্তনের প্রভাবক।

রাকিব/এখন সময়